রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে গভীর রাতে অদৃশ্য দূষণের খেলা: শিল্পবর্জ্যে বিপর্যস্ত জনজীবন

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঝিলিম ইউনিয়নের আতাহার এলাকায় গভীর রাতে এক অদৃশ্য ‘দূষণের খেলা’ চলছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতিদিন রাতে নাবা পোল্ট্রি ফার্ম নিয়োগপ্রাপ্ত ঠিকাদাররা ট্রাকভর্তি মুরগির বিষ্ঠা ও অন্যান্য বর্জ্য ফেলে যাচ্ছেন এখানে। ফলে আশপাশের ফসলি জমি ও পরিবেশ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তীব্র দুর্গন্ধে বসবাস অনুপযোগী হয়ে উঠেছে এলাকার পরিবেশ, আর কৃষকদের কপালে পড়েছে দুশ্চিন্তার ভাঁজ।
শনিবার (০৮ মার্চ) সরজমিনে গেলে উঠে আসে সত্যতা। ঝিলিম ইউনিয়নের দক্ষিণ শহর গ্রাম এবং রাঁধুনীডাঙ্গা ছোট পাইকোড়তলা রাস্তার পাশে, কৃষি জমিতে মুরগীর বিষ্ঠার স্তৃপ।
কারা ফেলছে, কারা পরিবেশ দূষণ করছে, কারা রোগজীবাণুর ধারক ও বাহক? এমন প্রশ্নে উঠে আসে ভয়ংকর তথ্য।
স্থানীয়রা জানান, ৪ দিন আগেই সেই বিষ্ঠার গাড়ি ধরা হয়েছিল। ভিডিও করাও হয়েছে। তাঁরা রাজশাহী শহরের নাবা পোল্ট্রি ফার্ম থেকে এই বর্জ্য নিয়ে আসে। নাবিল গ্রুপের গাড়িতে করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রাজমিস্ত্রী বলেন, রাত ১টা থেকে রাত ৩টার মধ্যে তাঁরা এই বিষ্ঠা ফেলতে আসে। ড্রাম ট্রাকে করে নিয়ে আসে। রাতে আমরা ভয়ে বের হইনা। কারন, এই কয়েকদিন আগে ধরা হয়েছিল সেই গাড়ির লোকজনকে। তাঁদের কাছে ধারালো অস্ত্র থাকে। স্থানীয় ইন্ধন তো অবশ্যই আছে। আমরা সেভাবে প্রতিবাদ করতে পারিনা কারণ আমাদের পরিবার আছে। আমরা প্রানের ভয়ে চুপ থাকি। কিন্তু আমাদের চলাচলে অনেক সমস্যা হয়।
ওই দক্ষিণ শহর গ্রামের মৃত বাবুলালের ছেলে আমিন (৬৫) একজন কৃষক। তিনি বলেন, এই বিষ্ঠা কখন ফেলে যায় কারা ফেলে যায় কেউ জানেনা। তবে, কৃষিকাজের পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। দুর্গন্ধে আমরা কৃষি কাজ করতে পারছিনা। কেউ কোন ব্যবস্থাও নিচ্ছেন না। চেয়ারম্যান মেম্বারের তো এদিকে আসতে হয় না তাই খবরও রাখেন না। আমরা সমস্যায় পড়েছি।
আতাহারের স্থানীয় বাসিন্দা গোলাম মোর্শেদ বিটিসি নিউজকে জানান, দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকায় মুরগির বিষ্ঠা ও অন্যান্য শিল্পবর্জ্য ফেলা হচ্ছে। দিনের আলোতে নয়, এই কাজ চলে রাতের আঁধারে। ফলে সকালের সূর্য ওঠার পরই এলাকাবাসী দেখতে পান জমিতে ছড়িয়ে আছে বিষাক্ত বর্জ্য। বৃষ্টির পানি এলেই রাস্তায় গড়িয়ে পড়বে। দুর্গন্ধ আরও ছড়াবে। এমনিতেই দুর্গন্ধে রোজা রেখে এই পাইকোড়তলা রাস্তা দিয়েন যাতায়াত কষ্টকর হয়ে গেছে।
একজন স্থানীয় সাহাদাত নামের একজন বলেন, “নয়াগোলা, জামতলা, নয়ানগর শিল্প এলাকা। আশফাক অটোরাইস মিলের পাশ দিশে গেলেই দেখতে পাবেন কত জায়গায় এই পোল্ট্রি বিষ্ঠা ফেলানো আছে। আমাদের জমির ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মাটির উর্বরতা কমে যাচ্ছে, পানির রঙ বদলে যাচ্ছে। আমরা কোনো সমাধান পাচ্ছি না।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, এভাবে খোলা জায়গায় শিল্পবর্জ্য ফেলা আইনত দÐনীয় অপরাধ।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) এর ধারা ৬ অনুযায়ী, কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো জায়গায় বর্জ্য ফেলে পরিবেশের ক্ষতি করে, তাহলে তাকে শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।
ফৌজদারি দÐবিধির ২৬৮ ও ২৭৭ ধারায়, জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পরিবেশ তৈরি করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং দোষীদের জরিমানা বা কারাদÐ হতে পারে।
পরিবেশ আদালত আইন, ২০১০ এর ধারা ৭ অনুযায়ী, পরিবেশ সংক্রান্ত যেকোনো অপরাধের বিচারকাজ পরিচালনার জন্য বিশেষ পরিবেশ আদালত রয়েছে, যেখানে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ জানাতে পারেন।
স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, ২০০৯ এর ধারা ৫৯ অনুসারে, ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্ব হচ্ছে পরিবেশ রক্ষা করা।
কিন্তু এসব আইনের বাস্তবায়ন চোখে পড়ছে না। বরং স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের নিরব ভ‚মিকা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, এই দূষণ অব্যাহত থাকলে স্থানীয় কৃষি, পানি ও জনস্বাস্থ্য ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে।
আতাহারের বাসিন্দারা এই দূষণ বন্ধে দ্রুত প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন। তারা চাইছেন—পরিবেশ অধিদপ্তর এবং স্থানীয় প্রশাসন দ্রুত পদক্ষেপ নিক। অবৈধভাবে বর্জ্য ফেলা বন্ধে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
যে জমিগুলো দূষণের কারণে নষ্ট হয়েছে, সেগুলোর পুনরুদ্ধারে উদ্যোগ নেওয়া হোক।
স্থানীয় জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আবু সাঈদ বিটিসি নিউজকে বলেন, এই বিষয়ে কোন অভিযোগ লিখিত কিংবা মৌখিক পাইনি। তবে, পরিবেশ রক্ষার্থে উল্লেখিত জায়গাগুলো পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসার মোছা. তাছমিনা খাতুন বিটিসি নিউজকে বলেন, এমন কোন বিষয় কেউ অবগত করেনি। তবে ভুক্তভোগী বা অভিযোগকারী সরাসরি এসে নির্দিষ্ট জায়গার ঠিকানা দিলে আমাদের সুবিধা হতো।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি মো. মাসুদ রানা রাব্বানী / রাজশাহী। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.