বিশেষ প্রতিনিধি:দীর্ঘদিনের অপেক্ষার পর অবশেষে ভোলা-বরিশাল-খুলনা গ্যাস পাইপলাইনের রুট পরিবর্তন করে প্রথম ধাপে ভোলা-বরিশাল-ঢাকা গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পেট্রোবাংলা। বরিশাল-খুলনা অংশের কাজ পরবর্তী ধাপে বাস্তবায়িত হবে বলে জানিয়েছেন সংস্থার চেয়ারম্যান রেজানুর রহমান।
তিনি জানান, ভোলা-বরিশাল পাইপলাইনের সম্ভাব্যতা যাচাই ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, এবং বরিশাল-ঢাকা অংশের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ৫ মার্চ ফাইল অনুমোদন করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশের গ্যাস সংকটের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে এ প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বিশেষত ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, টঙ্গীসহ শিল্পাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা দিতে এটি সহায়ক হবে।
ভোলার গ্যাস মজুদ ও উত্তোলন পরিস্থিতি
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত ভোলা অঞ্চল, যেখানে এখন পর্যন্ত খননকৃত প্রতিটি কূপে গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। এ কারণে ভোলা বর্তমানে দেশের জ্বালানি খাতের অন্যতম সম্ভাবনাময় অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ভোলার গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাস মজুদ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মোট ৯টি কূপ খনন করা হয়েছে, যা থেকে দৈনিক ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন সম্ভব। বর্তমানে শুধুমাত্র ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে, কারণ স্থানীয়ভাবে গ্যাসের চাহিদা কম এবং জাতীয় গ্রিডে সংযোগ নেই। উত্তোলিত গ্যাসের একটি অংশ সিএনজি আকারে গাজীপুরের কিছু কারখানায় সরবরাহ করা হয়, যা মাত্র ৩ মিলিয়ন ঘনফুট। সরকার ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে প্রতিদিন ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস এলএনজি আকারে সরবরাহের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তবে এই পদ্ধতি কতটা অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে।
পাইপলাইন নির্মাণ নিয়ে দীর্ঘসূত্রতা ও অর্থায়ন সংকট
ভোলা থেকে খুলনায় গ্যাস সরবরাহের জন্য ১৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন নির্মাণের পরিকল্পনা দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় থাকলেও অর্থায়নের অনিশ্চয়তার কারণে প্রকল্পটি আটকে ছিল। ২০০৪ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (ADB) প্রকল্পের অর্থায়নে নিশ্চয়তা চেয়েছিল, যা না পাওয়ায় পরিকল্পনাটি স্থগিত হয়ে যায়। এ প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা, যা নিশ্চিত করতে ঋণদাতারা গ্যাস মজুদের যথাযথ নিশ্চয়তা চাইছে।
অন্যদিকে, পেট্রোবাংলা বর্তমানে ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানির ওপর অধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। একটি এলএনজি কার্গো আমদানিতে খরচ হয় ৬৪৯ কোটি টাকা, যা দেশের এক দিনের গ্যাস চাহিদার (৩০০০ মিলিয়ন ঘনফুট) সমান। ২০২৫ সালে ১১৫টি এলএনজি কার্গো আমদানি করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশীয় গ্যাস সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে ব্যয় সাশ্রয় করা সম্ভব।
দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মজুদ হ্রাস ও সংকটের শঙ্কা
বাংলাদেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মজুদ দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে এবং উৎপাদনও ক্রমাগত কমছে। একসময় দৈনিক ২৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হলেও এখন তা ১৯০০ মিলিয়নের নিচে নেমে এসেছে। দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানার মজুদ ২০২৬ সালের মধ্যে শেষ হয়ে যেতে পারে। বিবিয়ানার গ্যাস সরবরাহ ৪ মার্চ ৯৪৫ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে এসেছে, যেখানে একসময় ১৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুট উৎপাদিত হতো।
শিল্পাঞ্চলে গ্যাস সংকটের প্রভাব
ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, টঙ্গীসহ দেশের প্রধান শিল্প এলাকাগুলোতে তীব্র গ্যাস সংকট চলছে। বিবিয়ানার উৎপাদন কমে গেলে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে, যা অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকি। এই সংকট নিরসনে ভোলা-বরিশাল-ঢাকা গ্যাস পাইপলাইন দ্রুত বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
গ্যাস অনুসন্ধানে ধীরগতি সংকটের অন্যতম কারণ হচ্ছে বাংলাদেশে অনুসন্ধান কূপ খননের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে খুব কম। গত ১১৩ বছরে মাত্র ৯৯টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ২৯টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে।
তুলনামূলকভাবে, যুক্তরাষ্ট্র প্রতি ১৪ বর্গকিলোমিটারে ১টি অনুসন্ধান কূপ খনন করে। ভারতে প্রতি ১৮.৬ বর্গ কিলো মিটারে ১টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্যাস অনুসন্ধানে ধীরগতির কারণেই বর্তমানে দেশের গ্যাস সংকট প্রকট হচ্ছে।
পেট্রোবাংলার বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রথম ধাপে ভোলা-বরিশাল-ঢাকা গ্যাস পাইপলাইন বাস্তবায়িত হবে। এরপর বরিশাল-খুলনা অংশের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এই পাইপলাইন নির্মিত হলে, শিল্পাঞ্চলের গ্যাস সংকট কমবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্থিতিশীলতা আসবে।
এছাড়া এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরতা কমবে, যা বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে সহায়ক হবে।
ভোলা-বরিশাল-ঢাকা গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত দেশের জ্বালানি খাতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে প্রকল্পটি সফল করতে অর্থায়ন, সময়মতো বাস্তবায়ন ও কারিগরি পরিকল্পনা নিশ্চিত করা জরুরি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও পাইপলাইন অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্ব না দিলে দেশের জ্বালানি সংকট আরও তীব্র হতে পারে। তাই দ্রুত ও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন, যাতে শিল্প ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত না হয়।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর বিশেষ প্রতিনিধি মাশরুর মুর্শেদ। #
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.