খুলনা ব্যুরো:দেড় হাজার বছরের পুরনো এক বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ভরত রাজার দেউল। খুলনার ডুমুরিয়া ও যশোরের কেশবপুর সীমান্তের ভরত ভায়না গ্রামে অবস্থিত এই প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির ইতিহাস, সংস্কৃতি ও রহস্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন। যদিও প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবে এটি এখনো দেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারেনি, তবুও দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীদের কৌতূহলের শেষ নেই এই স্থাপনাটি ঘিরে।
প্রবীণদের মতে, ভরতের দেউল আনুমানিক ১৫০০ বছরের পুরনো এক বৌদ্ধ মন্দির। এটির উচ্চতা ১২.২০ মিটার এবং পরিধি ২৬৬ মিটার। ধারণা করা হয়, ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে দেউলটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ১৯২৩ সালে এটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়।
২০০১ সাল পর্যন্ত করা একাধিক খননে মন্দিরের মূল কাঠামো, মঞ্চ, ৯৪টি কক্ষ এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়। প্রাপ্ত নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে পোড়া মাটির তৈরি নারীমুখ মূর্তি, সুদৃশ্য নকশা করা ইট, পোড়ামাটির অলংকার ও দেব-দেবীর টেরাকোটা ভগ্নাংশ ও মাটির ডাবর (মাটির পাত্র)।
চারপাশে ৪টি দেওয়ালে ঘেরা ১২টি কক্ষের পাশাপাশি ৮২টি কক্ষ বৌদ্ধ স্তূপের আকারে নির্মিত হয়েছে। স্তূপের চূড়ায় চারটি কক্ষের দুই পাশে আরও আটটি ছোট ছোট কক্ষ রয়েছে।
ডুমুরিয়ার শোলগাতিয়া ব্রিজ পার হয়ে মাত্র ১ কিলোমিটার গেলেই সবুজ ছায়া ঘেরা নয়নাভিরাম গ্রাম ভরত ভায়না। পাখির কিচিরমিচির, বটগাছের ছায়া আর নিরিবিলি পরিবেশে এই দেউলটি দাঁড়িয়ে আছে এক অতীত সাক্ষী হয়ে।
প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী এখানে ভ্রমণে আসছেন, যদিও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে অনেকেই হতাশ হন।
সাতক্ষীরার আশাশুনি থেকে আসা দর্শনার্থী একে আজাদ বিটিসি নিউজকে বলেন, “বাড়ির এত কাছে এত সুন্দর পুরাকীর্তি আছে, অথচ ৫০ বছর বয়সে এসে প্রথম দেখলাম! স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য এটি অত্যন্ত শিক্ষণীয়।”
বিশিষ্ট কবি ও শিল্পী অমিয় কান্তি পাল বিটিসি নিউজকে বলেন, “অদ্ভুত সুন্দর এই স্থাপনা। এখানে যারা সিকিউরিটির দায়িত্বে আছেন, তারাও খুব ভদ্র এবং সাহায্যকারী।”
যশোরের আব্দুল ওহাব বিটিসি নিউজকে বলেন, “সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন। দেখে খুব ভালো লাগলো, তবে আরও উন্নয়ন দরকার।”
ডেইলি স্টারের সাংবাদিক দীপংকর রায় মন্তব্য করেন, “অনেক বিদেশি পর্যটক এখানে আসেন, কিন্তু তাদের জন্য বসার স্থান বা বিশ্রামের কোনো ব্যবস্থা নেই। একজন প্রশিক্ষিত গাইডেরও প্রয়োজন আছে।”
যশোর রাজ্জাক কলেজের সহকারী অধ্যাপক শাহিন বিটিসি নিউজকে বলেন, “এখানে একটি দৃষ্টিনন্দন প্রবেশদ্বার, ওয়াশরুম, টয়লেট, গাড়ি পার্কিং এবং রান্নার ব্যবস্থা থাকা উচিত।”
বিআরডিবির ডিডি বিএম কামরুজ্জামান বিটিসি নিউজকে বলেন, “এটি কুমিল্লার শালবন বিহার বা মহাস্থানগড়ের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। প্রচার-প্রসার দরকার।”
বর্তমানে এটি বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। এখানে থাকা ডিসপ্লেরুমের কর্মকর্তা সফিয়ার রহমান (যিনি ৪২ বছর ধরে এখানে কর্মরত) জানান, “প্রাথমিকভাবে এখানে ১.৭৬ শতক জমি ছিল, পরে আরও ৩.৬৫ শতক যোগ হয়েছে।
এখন একটি মাস্টার প্ল্যান করা হয়েছে, যার মাধ্যমে এখানে হোটেল, আধুনিক বাথরুম, যাদুঘর, পার্ক, আনসার ক্যাম্প, পিকনিক স্পট ও রান্নার স্থান নির্মাণ করা হবে। যদি এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়, তাহলে ভরতের দেউল আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে।”
দর্শনার্থীদের জন্য উম্মক্ত থাকে, মঙ্গলবার – শনিবার: সকাল ১০টা – বিকাল ৬টা, সোমবার: দুপুর ২টা – ৬টা পর্যন্ত। রবিবার সাপ্তাহিক বন্ধ থাকে।
ভরতের দেউলকে আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পর্যাপ্ত বিশ্রামাগার ও হোটেল নির্মাণ, আধুনিক শৌচাগার ও ওয়াশরুমের ব্যবস্থা, পর্যটকদের জন্য গাইড ও তথ্য কেন্দ্র, পথচারী বিশ্রাম স্থান ও বসার জায়গা,পর্যাপ্ত গাড়ি পার্কিং ও পিকনিক স্পট ও আরও গবেষণা ও প্রচারণা বৃদ্ধির প্রয়োজন।
ভরতের দেউল বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যথাযথ পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে এটি হয়ে উঠতে পারে মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের মতো অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক ও পর্যটন কেন্দ্র।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.