বাসের বুকিং সহকারী থেকে শত কোটি টাকার মালিক ডাবলু সরকার

 

নিজস্ব প্রতিবেদক: গত বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারের একটি অশ্লীল ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ডাবলু সরকারের বিচার এবং দল থেকে বহিস্কারের দাবিতে মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে নগরীতে দফায় দফায় মানববন্ধনসহ বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচিও পালন করেন।

ওই ঘটনার পরে প্রায় এক বছর রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের কোনো আয়োজনে ডাবলু সরকারকে আর দেখা যায়নি। তাঁকে অনেকটা কোণঠাসা করে রেখেছিলেন এখানকার নেতাকর্মীরা। তবে কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতার আশীর্বাদপুষ্ট ডাবলু সরকারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি আওয়ামী লীগ।
বিশেষ করে বিকাশ কামাল বলে পরিচিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত) এসএম কামালের ঘোনিষ্ট হওয়ায় ডাবলু সরকার সে যাত্রায়ও রক্ষা পান বলে চাউর হয়।
কিন্তু গত ৫ আগস্টের কয়েক দিন আগ থেকে এই ডাবলু সরকার আবারও মহানগর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে হঠাৎ করে সক্রিয় উঠেন। বিশেষ করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমাতে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
৫ আগস্টের দিন দুপুরে নগরীর আলুপট্টিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর হামলায় সামনে থেকেও নেতৃত্বে দেন ডাবলু সরকার। ওইদিনের ঘটনায় দু’জন আন্দোলনকারী নিহত হওয়ায় দুটি হত্যা মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে, তার মধ্যে ডাবলু সরকার অন্যতম।
তবে সেদিন থেকেই পলাতক রয়েছেন অন্তত তিনশ কোটি টাকার সম্পদের মালিক রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের এই প্রভাবশালী নেতা। অথচ এক সময় ছিলেন বাসের বুকিং সহকারী।
দলীয় সূত্র মতে, কেবল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সুবাদেই ডাবলু সরকারের উত্থান হয়েছে। কিন্তু তার কোনো বৈধ ব্যবসা ছিল না। রাজনীতির দাপটে রাজশাহী নগরীর আলুপট্টিতে বিআরটিসি বাস কাউন্টারের গোটা নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তার হাতে। রাজশাহী রুটের সমস্ত বিআরটিসি বাসের নিয়ন্ত্রকও ছিলেন তিনি।
একপর্যায়ে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ বাগিয়ে নিয়ে গোটা নগরীতেই ডাবলুর বিচরণ শুরু হয়। দলীয় প্রভাবে টেন্ডার বাণিজ্য, সংখ্যালঘুদের জমি দখল, বস্তিবাসিদের জমি দখল, জালিয়াতির মাধ্যমে পাঁচ-সাত বছরের মধ্যেই কয়েক অন্তত ৩০০ কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেন তিনি।
২০১৯ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক বৈঠকে ডাবলু সরকারের বিরুদ্ধে শত কোটি টাকার সম্পদ অবৈধভাবে অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়। ওই বৈঠকে রাজশাহীর আটজন আওয়ামী লীগ নেতার সম্পদ অনুসন্ধানের জন্য একটি তালিকা দুদকের রাজশাহী আঞ্চলিক অফিস থেকে প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছিল। সেই তালিকায় প্রথমে ছিল ডাবলু সরকারের নাম। প্রাথমিক তদন্ত করে এ তালিকা পাঠিয়েছিল দুদকের রাজশাহীর কর্মকর্তারা।
দুদকে দেওয়া ডাবলু সরকারের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছিল, রাজশাহীর কুমারপাড়ায় ‘সখিনা বোর্ডিং’ দখল করে এক হিন্দু ব্যবসায়ীকে দেশ ছাড়া করেন ডাবলু সরকার। পরে তিনি সেখানে ১০ তলাবিশিষ্ট সরকার টাওয়ার নির্মাণ করেন। রাজশাহীর সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে আব্দুল জলিল বিশ্বাস মার্কেটটি নামমাত্র মূল্যে দখলে নেন তিনি।
রাতের আঁধারে ছোটবনগ্রামের বস্তিবাসী উচ্ছেদ করে ১২ বিঘা জমি দখল করেন। কুমারপাড়ার বিআরটিসির ডিপোর জায়গাটি এক হিন্দু পরিবারের কাছ থেকে দখলে নেন ডাবলু।
পাশাপাশি রাজশাহীর কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও ডাবলু সরকারের বিরুদ্ধে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও দুদক চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। অভিযোগে মুক্তিযোদ্ধারা উল্লেখ করেছিলেন, সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবারের বাড়িঘর দখল ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন ডাবলু সরকার। অথচ তিনি এখনো বিআরটিসির বাসের বুকিং সহকারী পদে কর্মরত। ডাবলু সরকারের বাবা আব্দুর রশিদ সরকার রাজশাহীর কুখ্যাত রাজাকার আব্দুস সাত্তার ওরফে টিপুর অন্যতম সহযোগী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, নির্যাতন, অপহরণ ও লুণ্ঠনের অভিযোগে ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এ মামলার চার নম্বর আসামি ছিলেন রশিদ সরকার।
দলীয় সূত্র মতে, ডাবলু সরকারের বোনজামাই (ভগ্নিপতি) নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মীর ইকবালের হাত ধরে ডাবলু সরকার আওয়ামী লীগে প্রবেশ করেন। নগর ছাত্রলীগের সাংগঠনিক পদ নিয়ে আওয়ামী লীগে আসা ডাবলু পরে নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদকেরও দায়িত্ব পালন করেন। এরপর মহানগর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক থেকে সাধারণ সম্পাদক পদ বাগিয়ে নেন দুইবার।
সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি দ্বিতীয় বারের মতো রাজশাহী মহানগর আওয়াম লীগের সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হয়েছিলেন।
নগরীর কুমারপাড়া এলাকার আজগর আলী নামের এক ব্যক্তি বলেন, কিছুদিন আগেও এই এলাকার একটি ৫কাঠা জমি রঘুশাহ নামের এক হিন্দু পরিবারের ছিল তাঁরাই এখানে বসবাস করতেন। কিন্তু তাঁদের উচ্ছেদ করে জমিটি দখল করে নেন ডাবলু সরকার। এর বাইরেও তিনি কুমারপাড়া ও আলুপট্টি এলাকায় বেশকিছু জমি দখল করেছেন বলে শুনেছি।’
নগরীর সাহেব বাজার এলাকার মাজদার হোসেন বলেন, মার্কেট জমি কোনো কিছুই বাদ যায়নি ডাবলু সরকারের রাহুগ্রাস থেকে। তার দখলকৃত জমি ও সম্পদের মূল্য তিনশত কোটির ওপরে হবে।
তবে ডাবলু সরকার পলাতক থাকায় এসব নিয়ে তার কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে নগরীর বোয়ালিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘ডাবলু সরকারের নামে চারটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে দুটি হত্যা মামলা রয়েছে। তবে তিনি পলাতক রয়েছেন। আমরা তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছি।’
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি মো. মাসুদ রানা রাব্বানী / রাজশাহী। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.