প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে খুলনার প্রার্থীদের নানা আর্জি
খুলনা ব্যুরো : খুলনা সিটি কর্পোরেশনের পাঁচ মেয়রপ্রার্থীই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে নিরপেক্ষ নির্বাচন চাইলেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে পেয়ে অনেক প্রার্থীই কথা বলতে চান। রোববার বিকেলে নগরীর বয়রাস্থ খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় কথা বলেন পাঁচ মেয়রপ্রার্থী, পাঁচজন সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী এবং ১৪ জন সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী।
বক্তৃতার ক্রম ছিল নামের অদ্যাক্ষর অনুযায়ী। এজন্য প্রথমেই বক্তৃতার সুযোগ পান জাতীয় পার্টির মেয়রপ্রার্থী এসএম শফিকুর রহমান মুশফিক। তিনি বলেন, সাবলিলভাবে যাতে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যেতে পারে সে পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। আচরণবিধি সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে তা যেন কথার কথা না হয়। সর্বশেষ তিনি কবিতার লাইন দিয়ে শেষ করেন ‘আমি এই মাটির ছেলে লাঙলের গোড়া ধরে আজও আছি বেচে’।
আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক নির্দিষ্ট সময় তিন মিনিটের আগেই তার বক্তব্য শেষ করেন। তিনি বলেন, সব প্রার্থীই নিরপেক্ষ নির্বাচন চান। আওয়ামীলীগের তৃণমূল নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ রেখেই নির্বাচনী প্রচারনা চালানো হচ্ছে। এ পর্যন্ত এমন কোন ঘটনা ঘটেনি যে অনাকাংখিত কোন অভিযোগ দিয়ে নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করতে হবে।
এমন যারা করছেন তাদেরকে তিনি অহেতুক অভিযোগ থেকে বিরত থাকারও আহবান জানান। বিএনপি মনোনীত প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু তিন মিনিটের পরিবর্তে আট মিনিট সময় দাবি করে বক্তৃতা শুরু করেন। কিন্তু তার জন্য সময় বৃদ্ধি করতে প্রথমে রাজী হননি কর্তৃপক্ষ। পরে সিইসির সাথে সঞ্চালক আলোচনা করে চার মিনিটের মধ্যে বক্তৃতা শেষ করার অনুরোধ জানান।
বক্তৃতায় তিনি বলেন, সিটি নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এ বছরই আরও একটি নির্বাচন আছে। সেটি হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন। সিটি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য না হলে তা হবে নির্বাচন কমিশনের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার স্থান তিনি সোনাডাঙ্গা বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের পরিবর্তে ২০১৩ সালের ন্যায় জেলা স্কুলে নির্ধারনের দাবি জানান।
কারণ মহিলা কমপ্লেক্স বাস টার্মিনাল সংলগ্ন ও দুর্গম এলাকায়। বিভাগীয় সমন্বয় কমিটিসহ নির্বাচনকেন্দ্রিক যেসব কমিটি করা হয়েছে সে ব্যাপারে বিএনপিকে অবহিত করা হয়নি বলে তিনি ওইসব কমিটি বাতিলের দাবি জানান। এ পর্যন্ত বিএনপির পক্ষ থেকে ২০/২২ টি অভিযোগ রিটার্নিং অফিসারের কাছে দেয়া হলেও তার কোন সুরাহা হয়নি বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
তিনি যেখানেই যাচ্ছেন সেখানেই হামলা হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড এখনও নিশ্চিত হয়নি বলেও তিনি জানান। এ পর্যন্ত তার দলের নগরীতে ২৫ জনকে এবং জেলায় ৫০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এজন্য তিনি নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের দাবি জানান। পাশাপাশি রাতের পরিবর্তে ভোটের দিন সকালে যাতে ভোটবাক্স কেন্দ্রে সরবরাহ করা হয় সে দাবি করার আগেই মাইক বন্ধ করে দেয়া হয়।
পরে তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে ১৬ দফা লিখিত সুপারিশমালা দেন। সিপিবি’র প্রার্থী মিজানুর রহমান বাবুও অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দাবি করেন। এ ব্যাপারে সিইসির কাছে তার দল বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি ও বাসদ-বাম মোর্চার পক্ষ থেকে দাবিনামা পেশ করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন। নির্বাচনে কালো টাকার ব্যবহার, পেশি শক্তি ও ধর্মের ব্যবসা বা বাণিজ্যিকীকরণ যাতে না হয় সে ব্যাপারে সিইসির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
কেসিসি নির্বাচনকে ঘিরে বর্তমানে কালো টাকার ছড়াছড়ি হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মনে হচ্ছে ঈদের আনন্দ বইছে। অবৈধ অস্ত্রধারীরাও মাঠে আছে উল্লেখ করে তিনি ২৪ ঘন্টার মধ্যে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার দাবি করেন। তা না হলে নির্বাচন অবাধ, অর্থবহ ও নিরপেক্ষ হবেনা বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মাওলানা মুজ্জাম্মিল হক বলেন, নির্বাচনকে ঘিরে অনেক বিধি নিষেধ দেয়া হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের দিন যদি নিরপেক্ষতা বজায় না থাকে তাহলে সবকিছু ভেস্তে যাবে। অতীতের অনেক নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, খুলনা একটি শান্তির শহর। নিরপেক্ষ নির্বাচন না হলে শান্তির খুলনার মাটি গরম হয়ে যাবে। সবাই চায় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। যারা সন্ত্রাস-দুর্নীতি করতে চায়, ব্যালট বাক্স ছিনতাই করতে চায় তাদের প্রতিহত করারও দাবি জানান তিনি।
মেয়রপ্রার্থী ছাড়াও কথা বলেন সংরক্ষিত ও সাধারণ ওয়ার্ডের প্রার্থীরা। প্রথমেই কথা বলেন, ৫ নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ডের প্রার্থী মেমোরি সুফিয়া রহমান শুনু। তিনি সিইসিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনার অধীনে বেশ কয়েকটি নির্বাচন প্রশংসা কুড়িয়েছে। খুলনার নির্বাচনও সুন্দর, নিরপেক্ষ দাবি করে তিনি বলেন, এখানে নির্বাচন পরিচালনার সাথে দায়িত্ব পালনকারী অনেকের রাজনৈতিক পূর্ব পরিচয় আছে।
তার পরেও বিবেকি মানুষ হয়ে যেন তারা দায়িত্ব পালন করেন। ৯ নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ডের প্রার্থী রুমা খাতুন বলেন, সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন তিনিও চান। তবে যেহেতু তিনটি ওয়ার্ড নিয়ে সংরক্ষিত ওয়ার্ডের প্রার্থীদের আসন। সে কারনে নির্বাচনের দিন প্রার্থীদের যাতায়াতের জন্য যানবাহনের অনুমোদন তিনি দাবি করেন।
৭ নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ডের প্রার্থী শামসুন্নাহার লিপি প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট দাবি করেন। ৯ নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ডের প্রার্থী লিভানা পারভীন একজন মেয়র প্রার্থী ও তার নিজের প্রতীকে ভোট প্রার্থনা করেন। ১০ নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ডের প্রার্থী রোকেয়া ফারুক সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন দাবি করে বলেন, ভোটাররা যাতে কেন্দ্রে যেতে পারে সে পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
১২ নম্বর সাধারণ ওয়ার্ডের প্রার্থী মো: সাহাবুদ্দিন কালো টাকার ছড়াছড়ি বন্ধের আহবান জানান। বিশেষ করে ভোটের আগের রাতে কালো টাকার ছড়াছড়ি হয় বলেও জানান তিনি। ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী জেড,এ মাহমুদ ডন বিএনপির মেয়রপ্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জুর বক্তব্যের বিরোধীতা করে বক্তৃতা দিতে গিয়েই সময় পার করেন।
৫ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী মো: হারুন অর রশীদ রিটার্নিং অফিসারকে বিএনপির লোক দাবি করে তাকে দায়িত্ব থেকে অপসারণ দাবি করে বলেন, তা না হলে নির্বাচ নিরপেক্ষ হবে না। ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী আব্দুর রহমান ডিনো বলেন, তাকে প্রচারনা চালাতে দেয়া হচ্ছে না। তার কর্মীদের বাড়িতে পুলিশ গিয়ে হয়রানি করছে। মামলা করে তার লোকদের নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। তিনি লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড দাবি করেন।
১৩ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী ইমতিয়াজ আলম বাবু নির্বাচনে সরকারি দলের জন্য এক ধরনের আর বিরোধীদের জন্য পৃথক নিয়ম দাবি করে বলেন, তার প্রধান নির্বাচনী এজেন্টকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দেয়া হচ্ছে। পোলিং এজেন্ট দিতে পারবেন কি না সে সংশয়ও করেন তিনি। ২১ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী এসএম শামীমুর আলম মান্দার একজন প্রার্থী রেলওয়ের জমিতে নির্বাচনী অফিস করেছেন বলে দাবি করে তা উচ্ছেদের দাবি জানান। এ ওয়ার্ডের অপর প্রার্থী মনিরুল ইসলাম বলেন, সাধারণ ভোটারদের মধ্যে এখনও ভয় কাজ করে।
তা দূর করতে ভূমিকা নিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী আনিসুর রহমান বিশ্বাষ বলেন, ভোটারদের ভোট দিয়ে ছবি তুলে এনে দেখাতে বলা হচ্ছে। এজন্য তিনি ভোটকেন্দ্রে মোবাইল নিষিদ্ধের দাবি জানান। ৯ নম্বর ওয়ার্ডের এমডি মাহফুজুর রহমান লিটনও অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দাবি করেন।
৫ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, পুলিশকে ব্যবহার করে তার বাড়িতে হামলা করা হচ্ছে। ২১ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী শামসুজ্জামান মিয়া স্বপন বলেন, সন্ত্রাসী, মাদক বিক্রেতা, অগ্নিসংযোগকারী, নিষিদ্ধ ঘোষিত পার্টির লোকদের গ্রেফতার করতে হবে। প্রশাসনকে ভুল বোঝানোর কোন সুযোগ নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
১ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী রোজিনা বেগম রাজিয়ার প্রচার কাজে ওই ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর বাধা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন। এমনকি তাকে হত্যারও হুমকি দেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী আলী আকবর টিপু বলেন, নির্বাচনী প্রচার কাজে তার স্ত্রীকে পর্যন্ত বাধা দেয়া হয়েছে। যারা বাধা দেয়া তারা মাদক মামলার আসামী।
তার ওয়ার্ডে অবৈধ টাকার প্রভাব রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি সরকারি দল করি, তাও কিছু করার নেই’। ৬ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী শাহ মো: ওয়াজেদ আলী মজনু বলেন, তার ওয়ার্ডেও কালো টাকার ছড়াছড়ি হচ্ছে। যেটি গত ২৯ মার্চের উপ-নির্বাচনেও দেখা যায়। পাবলা কারিগরপাড়ার লোকজন ভোট দিতে পারবে কি না সে সংশয়ও করেন তিনি।#
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.