বিশেষ প্রতিনিধি: দৃশ্যমান কোনো আয়ের উৎস নেই নড়াইল আড়পাড়া এলাকার বাসিন্দা বেনজির হোসেনের। তারপরেও মাত্র পাঁচ বছরে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। এলাকায় তার প্রভাব ও দানশীলতায় নাম–ডাক ছড়িয়েছে পাশের আরও কয়েক গ্রামে। পাঁচ বিঘা জমির ওপর দু’টি ডুপ্লেক্স ভবন, যেখানে থাকেন বেনজির। কিন্তু গ্রেপ্তারের পর নিজেকে ছাপোশা মানুষ বলেই পরিচয় দেন। তবে তাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে আসলে চক্ষু চড়কগাছ পুলিশের কর্মকর্তাদের।
পুলিশ বলছে, জীবনের প্রথমে একটি চাকরিতে যোগ দিলেও চুরির দায়ে তার চাকরি চলে যায়। তারপর আর কোনো চাকরি করেননি তিনি, শুরু করেন প্রতারণা। দীর্ঘ পাঁচ বছরে ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে বিভিন্ন সময়ে অন্তত ৫০ জন নারীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে প্রতারণার অর্থ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে চাকরি দেওয়ার নামে হাতিয়ে নেওয়া অর্থ দিয়ে এতো কিছু করেছেন তিনি। সম্প্রতি তিন কোটি টাকায় তিন বিঘা জমির ওপর তৈরি বিলাসবহুল ভবন কিনেছে। এ ছাড়া ২০ বিঘার মাছের ঘের এবং যশোর ও ঢাকার সাভারসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নির্মাণাধীন আরও কয়েকটি ভবনের কাজ চলছে তার।
গত ২২ নভেম্বর খুলনার ফুলতলা এলাকায় প্রতারণার টাকা ক্যাশ আউট করার সময় হাতেনাতে তাকে গ্রেপ্তার করে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের টিম লিডার সহকারী কমিশনার আরিফুর রহমান তুহিন।
এ বিষয়ে জানাতে আজ সোমবার (২৭ নভেম্বর) রাজধানীর ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (সিটিটিসি প্রধান) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, প্রতারক বেনজির যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শাহিদ হাসান নামে এক বাংলাদেশি বিমান চালকের ফেসবুক আইডি হুবহু কপি করে একটি ভুয়া আইডি তৈরি করেন। এটি বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য তিনি শাহিদের আইডি থেকে নেওয়া বিমান চালনার ছবি ও ভিডিও নিয়মিত পোস্ট করতেন। তার প্রধান টার্গেট নিঃসঙ্গ নারীরা। পরে প্রেমের ফাঁদে ফেলে তাদের পরিবারসহ আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাতেন। এর একপর্যায়ে বিপদে পড়ার কথা বলে তার দেওয়া বিভিন্ন নগদ নম্বরে টাকা পাঠাতে বলতেন তিনি।
তিনি বলেন, বেনজিরের প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত এমন ১৩টি নগদ নম্বরে গত চার মাসে এক কোটি টাকারও বেশি লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। নড়াইলের বাড়িতে থেকে প্রতারণার কাজ করলেও তিনি টাকা উঠাতেন যশোর ও খুলনার বিভিন্ন ক্যাশ আউট পয়েন্ট থেকে। অন্যের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে নগদ অ্যাকাউন্টের নম্বরগুলোতে ব্যবহৃত সিমকার্ড রেজিস্ট্রেশন করা। এ ছাড়া প্রতারণার টাকা ক্যাশ আউট করার সময় বেনজির সবোর্চ্চ সর্তকতা অবলম্বন করতেন। তিনি ক্যাপ, সানগ্লাস ও মাস্ক পরে টাকা উত্তোলন করতেন। সম্প্রতি এমন একজন সিঙ্গেল মাদার বেনজিরের প্রতারণার শিকার হয়ে প্রায় কোটি টাকা খুইয়েছেন। আরেক জন খুইয়েছেন প্রায় ১৫ লাখ টাকা। এদের মধ্যে একজন ভুক্তভোগী গত ২১ নভেম্বর ডিএমপির ওয়ারী থানায় মামলা করে। পরে ছায়া তদন্তে নামে সিটিটিসির সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ। পরের দিন ২২ নভেম্বর বেনজিরকে খুলনার ফুলতলা থেকে গ্রেপ্তার করে।
সিটিটিসি বলছে, রোমান্স স্ক্যাম ছাড়াও বেনজির বিভিন্ন সময় পুলিশ পরিচয়ে প্রতারণা, সেনাবাহিনী ও পুলিশে চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা, হুন্ডি ব্যবসা ও মানব পাচারের মতো নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। প্রতারণার টাকা দিয়ে তিনি অর্থ-সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। নড়াইলে পাঁচ বিঘা জমির ওপর দুটি ডুপ্লেক্স ভবনসহ বাগানবাড়ি, জেলার বিভিন্ন জায়গায় ২০ বিঘার মতো মাছের ঘের ও একাধিক নির্মাণাধীণ ভবনের পাশাপাশি যশোর ও সাভারেও বহুতল ভবন আছে তার।
এক প্রশ্নের জবাবে সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান বলেন, বেনজির এইচএসসি পাস করে একটা চাকরিতে যোগ দেয়। চুরির দায়ে সেই চাকরি চলে যায়। সে খুবই নিন্মবিত্ত পরিবারের সন্তান। তার বাবা ওই অঞ্চলের বিভিন্ন হাট বাজারে তালের শাস বিক্রি করতেন। তবে খুব মেধাবী ছিল বেনজীর। তার বৈধ কোনো পেশা নাই। তার কাজই প্রতারণা করা। এলাকার সাধারণ মানুষ সন্দেহ করলেও ভয়ে তারা মুখ খুলতেন না।
দেশে থেকে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতারক বেনজীর যুক্তরাষ্ট্রের সময় মেনে নারীদের সঙ্গে কথা বলতেন। তবে কারও সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলতেন না। টাকা নেওয়ার সময় যুক্তরাষ্ট্রে তার ক্রেডিট কার্ড বন্ধ করে দিয়েছে, বলে জানাতো। তার প্রতারণার শিকার অসংখ্য নারী। এর মধ্যে তার প্রতারণার শিকার হয়ে এক নারী আত্মহত্যাও করেছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর বিশেষ প্রতিনিধি রুহুল আমীন খন্দকার। #
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.