নিজস্ব প্রতিবেদক: নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) রাজশাহী বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-৩ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শাহাদৎ হোসেনের সরকারি গাড়িচালিত দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন এক ভ্যানচালক।
ঘটনাটি ঘটে, ২ জুন সকাল ৯টা ২০ মিনিটে, রাজশাহী শহরের সপুরা এলাকার ম্যাংগো টাওয়ারের সামনে।
নিহত মোস্তাফিজুর রহমান সুমন (৪৭) ছিলেন, বিসিক এলাকার একজন ভ্যানচালক ও পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। ঘটনাটি শুধু একটি সড়ক দুর্ঘটনা নয়—এটি সরকারি সম্পদের অপব্যবহার, প্রশাসনিক দায়িত্বহীনতা ও বিচারহীনতার এক বেদনাদায়ক চিত্র হয়ে উঠেছে।
সেদিন ম্যাংগো টাওয়ার সংলগ্ন আরকে টাইলসের গোডাউনের পাশে একটি ট্রাক মাল খালাস করছিল। এ সময় ভ্যানচালক সুমন ট্রাকটিকে পাশ কাটিয়ে এগোতে গেলে পিছন থেকে একটি দ্রুতগতির মাইক্রোবাস তাকে ধাক্কা দেয়।যার নম্বর-ঢাকা-মেট্রো ঠ ১৩-৩৮৮৩। ধাক্কায় তার মাথা ট্রাকের গায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে গুরুতর আহত হন এবং হাসপাতালে নেওয়ার পর তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
পরবর্তীতে জানা যায়, মাইক্রোবাসটি ছিল নেসকো প্রকৌশলী শাহাদৎ হোসেনের জন্য নির্ধারিত সরকারি গাড়ি, যা তার ছেলেকে স্কুলে পৌঁছাতে ব্যবহৃত হচ্ছিল।
সরকারি গাড়ি ব্যবহার সংক্রান্ত বিধিমালায় স্পষ্টভাবে বলা আছে—এই যানবাহন শুধুমাত্র সরকারি কাজে ব্যবহারযোগ্য। অথচ শাহাদৎ হোসেন নিয়মিতই ব্যক্তিগত প্রয়োজনে এটি ব্যবহার করে আসছেন বলে জানিয়েছেন নেসকোর একাধিক কর্মকর্তা।
এমনকি তার সাবেক ড্রাইভার মো. দিলসাদ অভিযোগ করেন, অতিরিক্ত ব্যক্তিগত চাপের কারণে তিনি চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। তার ভাষায়, “সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ডিউটি করতে হতো, পেন্সিল আনতেও গাড়ি চালাতে হতো। ঘুমের ঘাটতিতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি হতো প্রায়ই।”
বর্তমান ড্রাইভার, এহসান হাবিব তিতাস একজন আউটসোর্সিং হেলপার হলেও মূলত গাড়ি চালাচ্ছেন এবং ঘরোয়া কাজও করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থলে উপস্থিত ট্রাকচালক আলমগীর হোসেন বলেন, “আমার ট্রাক সাইডে দাঁড়িয়ে ছিল। কোনো জ্যাম ছিল না। পেছন থেকে সরকারি গাড়ি এসে ধাক্কা দিলে ভ্যানচালক মারা যান। অথচ আমাকে জরিমানা করা হয় ৪৩,৫০০ টাকা।” বিস্ময়করভাবে, দুর্ঘটনার মূল গাড়িটি জব্দ না করে ট্রাকটিকে তুলে নিয়ে যায় বিসিক ফাঁড়ি পুলিশ। এতে পুলিশের নিরপেক্ষতা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
নিহতের পরিবার থেকে দেওয়া অপমৃত্যু মামলার বিবরণেও রয়েছে অসঙ্গতি।মামলার বাদী মোখলেসুর রহমান নিজেই বলেছেন, তাদের কোনো অভিযোগ নেই। এমনকি অভিযোগপত্রে চাচাতো ভাই নয়, স্বামী উল্লেখ করা হয়েছে—যা তদন্তে উদাসীনতার প্রমাণ দেয়। একইসঙ্গে অভিযোগ রয়েছে, ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহল সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। লাশের ময়নাতদন্ত না করেই দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, নিহতের পরিবারকে মামলা না করার জন্য চাকরির প্রলোভনও দেখানো হয়েছে।
নেসকোর সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. আব্দুর রশিদ বলেন, “এ বিষয়ে আমি অবগত নই। কেউ ব্যক্তিগত কাজে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করলে সেটি অনিয়ম। দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে তার পরিবারকে চাকরি দেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই।”
নির্বাহী প্রকৌশলী শাহাদৎ হোসেন নিজে বলেন, “ঘটনাটি সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই। আমি আমার ছেলেকে রিকশায় স্কুলে পৌঁছে দিয়েছি।” কিন্তু তার ড্রাইভার এহসান হাবিবের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। এক পর্যায়ে মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেন।
নিহত মোস্তাফিজুর রহমান সুমনের স্ত্রী ও সন্তানেরা আজ চরম আর্থিক অনিশ্চয়তার মুখে। পরিবারের কেউই এখনও এই মর্মান্তিক ঘটনায় মানসিকভাবে স্বাভাবিক হতে পারেননি।
নেসকোর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “যে গাড়ির জন্য সরকার ব্যয় বহন করছে, সেটি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহৃত হলে তা পুরো জাতির সঙ্গে প্রতারণা।”
স্থানীয়দের অনেকেই অভিযোগ তুলেছেন, এই দুর্ঘটনা শুধু একজন ভ্যানচালকের জীবন কেড়ে নেয়নি, বরং প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা, প্রভাবশালী কর্মকর্তার অপকর্ম ঢাকার অপচেষ্টা, এবং দুর্বল তদন্ত ব্যবস্থার নগ্ন চিত্রও তুলে ধরেছে।
জনসাধারণ এখন জানতে চায়—নির্বাহী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? ঘটনার প্রকৃত তদন্ত হবে তো?
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি ইফতেখার আলম (বিশাল) / রাজশাহী। #
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.