নিভৃতে ভালোলাগাঃ “পুনঃশ্চ তোমার ঘ্রাণ”

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি: হাসনাইন সাজ্জাদী (বিজ্ঞান কবি, লেখক ও সাংবাদিক)।

লেখকঃ বিনয় কে. মন্ডল, ধরণঃ কবিতা,

প্রকাশকঃ গতি, একুশে বইমেলা/১৯, ৪ ফর্মা,

মূল্য-১৫০ টাকা।

কবিতা কবি মনের অনেক পাওয়া না পাওয়ার ভালোলাগা, মন্দলাগা এবং আশা নিরাশার প্রতিভূ। কবিতা ব্যক্তির দর্শন। কবিতা বিজ্ঞানও, যদি সে কবিতা হয় প্রাগ্রসর। উপমা, উপেক্ষা ও চিত্রকল্পে সময়কে ধারণ করাই কবিতা। ভাব, ভাষা ও দর্শনেও থাকবে আগাম ভাবনা। না হলে শিল্পে ভাবনা অনুপস্থিত থাকে। শিল্প ছাড়া কবিতা হয় না। ভেতর ও বাহিরের বিজ্ঞানের সাথে গাঁথুনি শক্ত হলেই শব্দের খেলা জমে ওঠে। সুন্দর শব্দের সুন্দরতম বিন্যাস তখনই কবিতা হয়ে ওঠে। শব্দকার তখন কবি হয়ে উঠেন। প্রথম গ্রন্থেই কবি হয়ে উঠেছেন বিনয় কে. মন্ডল। তাঁর কাব্যগ্রন্থ “পুনঃশ্চ তোমার ঘ্রাণ” পাঠ করে আমার তাই মনে হয়েছে। তাকে কবি হতে অপেক্ষা করতে হবে না। শুরুতেই তিনি কবির তালিকায় নাম লেখাতে পেরেছেন। মনে হয় প্রস্তুতি নিয়েই তিনি এসেছেন। এ প্রস্তুতি কবিতার রাজপথকে হৃদয়ের রক্তক্ষরণে সমৃদ্ধ করার। সময়কে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দেবার। আবারো পুনরাবৃত্তি করছি কবি হবার পথকে তিনি সহজ ও সংক্ষিপ্ত করে নিয়ে এসেছেন। তাঁকে তাই অভিবাদন জানাতেই হয়। অভিনন্দন জানাই কবিকে।

মোট ৮৩ টি কবিতা স্থান পেয়েছে তাঁর কাব্যগ্রন্থে। প্রেম, বিদ্রোহ, স্বদেশিকতা, নীতিকথা, দুর্যোগ, স্মৃতি কাতরতা, প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রতিবেশ, সংগ্রাম, সংঘাত, স্বপ্ন, ব্যর্থতা, প্রেমকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা, অভিমান এবং বিজ্ঞান মনষ্কতা সবই স্পর্শ দিয়ে গেছে তাঁর কবিতায়। কবি যখন লিখেন-“তুমি চলে গেলে বসন্ত ফিরে যায়/বৃন্ত থেকে ঝরে যায় গোলাপ/রাতের তাঁরাগুলো খসে পড়ে/পৃথিবী ঢেকে যায় অন্ধকারে”। (জোড়/পৃষ্ঠা-১১) তখন প্রেমটা বড় হয়ে যায়। প্রেম ছাড়া আর কিছু থাকে না। সত্যি হয়ে যায় কবি মনের আকুতি। “তুমি আমার আজম্ম পিপাসা/নিভৃতে ভালোলাগা/আমার থাকা ও না থাকা জুড়ে”। (প্রাগুক্ত) তখন প্রেম ছাড়া কবি মনে আর কিছু থাকে? কবি তাঁর গ্রন্থের অধিকাংশই রোমান্টিকতায় কাতর। কিন্তু তার মধ্যেও বিষাদময় হয়ে উঠেছেন কোন কোন বাক্যে। যেমন- “চিরদিন কিছু সুখ বয়ে বেড়ায় মৃত্যু/শুধু চিবুকের কাছে অবশিষ্ট থাকে দীর্ঘশ্বাস/মৃত্যুরা আকাশের মতো সুন্দর সকালের ভারী বুকে”।

তারপর তিনি আবার আশাবাদী হয়ে উঠেন। আশান্বিত করেন তাঁর প্রেমকে। এখানে পাঠককেও বলা যায়। পাঠক এক অর্থে কবির প্রেমেরই ক্যানভাস।

এই কবিতায় তিনি লিখেছেন-“তবুওতো পাখি গান গায়/বাতাসী রঙে রঙিন প্রজাপতি উড়ে যায়/পিপিলিকা খাদ্য সঞ্চয় করে পুরাতন নিয়মে…”। (প্রিয়তম সময়ের কান্না, পৃষ্ঠা-১০)।

কবি সাধক। শব্দের জন্য, বাক্যের জন্য এবং শিল্পের জন্য কবির সাধনা চলে। কবি নিজেকে ভাঙেন আবার গড়েনও। সব মিলিয়ে কবির সাধনা তাঁর প্রেম। প্রেমের সাধনায় কবি বিনয় কে. মন্ডল এভাবেই সফলতা দেখান;- “বহুকাল ধ্যানমগ্ন ছিলাম নিজের ভিতর/কোন এক পূর্ণিমায় তুমি এসে সম্মূখে দাঁড়ালে/আমি তোমার আপন আলোয় উতপ্ত হলাম। (একটি কথা দাও, পৃৃষ্ঠা-১২)। তখন কবি মনের প্রেমের উত্তাপ পাঠক হৃদয়ে এসে স্থান করে নেয়। কবির সাথে পাঠকের একাত্মতার মধ্যেই রয়েছে কাব্যের সার্থকতা। এভাবে একের পর এক কবিতায় কবি তাঁর অস্তিত্বের প্রমান রেখেছেন। যুথবদ্ধ করেছেন সবাইকে।

কবির ভিতরে শুধু প্রেম থাকে না। থাকে কিছু জ্বালা, কিছু দহন, কিছু প্রতিবাদ এবং সেই প্রতিবাদ বর্ণমালায় জ্বাজ্জ্বল্যমান হয়। তখনই যখন কবি জনগণের হন, মানুষের ব্যথা ও বেদনায় একাত্মতা প্রকাশ করতে পারেন। কবি বিনয় কে. মন্ডল সে চেষ্টাই করেছেন। কিছুটা সার্থকও হয়েছেন। লিখেছেন;- “নিরীহের গলিত হার নিয়ে গেছে কুকুর/তোমার ক্ষুধার আগুন এনেছে দুুর্ভিক্ষ /নব প্রজম্মের অভিশপ্ত পৃথিবীতে”। (কল্যানীয়াসু, পৃষ্ঠা-১৪)।

বিরহ কাতরতা কবির অলংকার। যথার্থই কবি লিখেছেন-“রৌদ্রের নিঃশ্বাসে শিশির শুকায়/ভালোবেসে রাত্রির দুঃখগুলো ঝরে পড়ে ঘাসের বুকে/আকাশের প্রসব বেদনার মতো….”। “যে চোখ অনবরত আটকে থাকে তোমার খোলা জানালায়/সে আজ ক্ষয়ে গেছে রাত্রির ঠোঁটে/বুকে তাঁর জমানো অন্ধকার…”। তখন অংকিত হয় বেদনার ধারাপাত। কবি হয়ে উঠেন নিয়ত দুঃখবাদী। আধুনিক কবিতায় দুঃখবাদই বড় স্বার্থপরতা। এই দু:খবাদই পূর্ণতা পায় কবির পথ চলায় এবং শব্দমালায়। তিনিইতো লিখেছেন- “নদীর জলের কি কোন শরীর খারাপ নেই?/তাদের ক্রমশ অন্তহীন বয়ে চলা/দিন নেই রাত্রি নেই সমুদ্রের টানে/স্রোত হয়ে ছুটে চলে চঞ্চলা বিরামহীন…”। (পুনঃজম্মে জল হবো, পৃষ্ঠা-১৭)।

কবি তাঁর কবিতাকে দর্শনে উতরে নিয়ে গেছেন এভাবে;- “রোদেরও ভালোবাসাবাসি থাকে উত্তাপে../মেঘ-ঢেউ-রোদ-ঝর্ণা ক্ষণজম্মা পৃথিবীতে…(শরীরি প্রতিবিম্ব, পৃষ্ঠা-২৩)। কিংবা “রায় আসে…/চিরদিন ফুলে ফুলে মধু নিবে মৌমাছি”। (শরীরি অধিকার, পৃষ্ঠা-১৮)।

কখনো তিনি বিজ্ঞান থেকে বেড়িয়ে গেছেন। আবার কোথাও আত্মস্থ করেছেন বিজ্ঞানকে। যখন লিখেন- “জ্যোৎস্না ঘুমালে পরে চাঁদ ডুবে যায়/শুধু তুমি জেগে থাকো অন্ধকার জুড়ে….। তখন তাঁর অতি আবেগ বিজ্ঞানকে করেছে আড়াল। কিন্তু মেঘ দেখে ভয় করার কিছু নেই, আড়ালে তাঁর সূর্য হাসেতো। পরের বাক্যেই তিনি বিজ্ঞানকে তুলে এনেছেন এভাবে- “জানালায় চোখ রাখি/যদি চোখে পড়ে চোখ/তবে কপালের টিপ হবে অবারিত নীল আকাশ..” (অবশিষ্ট জীবন, পৃষ্ঠা-২৪)। টিপটা যদি নীল রঙের হয় তবে কবির দুঃখ বেড়ে বেড়ে নীল আকাশই হবে। আকাশতো শূন্যই।

আমাদের এই পৃথিবী গ্রহের জম্ম ৪৫৪ কোটি বছর আগে। তাই এটি পুরানো হয়ে গেছে। যে কথা তিনি বলেছন- “পুরানো পৃথিবী হেঁটে হেঁটে/কতগুলো জ্যোৎস্না চাই?/কুয়াশার চাঁদর মুড়ি দিয়ে কতটা শিশিরে ভিজতে চাও?..(অমীমাংসিত স্বপ্নগুলো, পৃষ্ঠা-৩০)। কবি বিজ্ঞানময় হয়ে লিখেছেন;- “রোদের পায়ে ভোর হয় এবং রাত্রি আসে/রোদের কাছে চিরকালই ঋণী রয়ে যাবো…”। তখনও বিজ্ঞান মুচকি হাসে প্রতিকী অর্থ। উপমা বাড়লে বাড়ানো যায়। তাতে লেখার কলেবর বাড়ে। কলেবর না বাড়ালেও কবির সার্থকতা অামরা জানতে পারি এইটুকুতেই। এ রকম বাক্যের চমৎকারিত্বে ম্যাজিক রিয়েলিজম আরো অনেক দেখিয়েছেন কবি। গ্রন্থ পাঠে আরো অনেক কিছু জানা যাবে। কাব্যগ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করি। আরো অসংখ্য কবিতা চাই কবি বিনয় কে. মন্ডলের ক্ষুরধার লেখনী থেকে।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি মোঃ লোকমান হোসেন পলা।#

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.