তিস্তাপাড়ের বর্গাচাষী মফিজুলের দিন বদলের গল্প

লালমনিরহাট প্রতিনিধি: ‘টাকার অভাবত আইজো একনা নিজের জমি হইল না। মাইনষের জমি দিয়া যেইকনা আয় উন্নতি হয়, তাতে চলা নাগে। নিজের জমি থাকলে সংসার চালাইতে এত ব্যাগ (বেগ) নাগিল না হয়। নিজে খায়া পড়ি (খেয়ে পরে) বেটিগুলাক মানুষ কইরবার পাইলে হইল।’
এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন লালমনিরহাটের তিস্তা নদীর তীর ঘেষা গ্রাম খোলাহাটির বর্গাচাষী মফিজুল।
৩৬ বছর বয়সী বর্গাচাষী মফিজুলের নিজের জমিজমা না থাকায় কখনও রিকশা চালিয়ে, কখনও বা গ্রামে গ্রামে ফেরি করে সংসার চলে তার। তার ফাঁকে যেটুকু টাকা জমানো যায় তাই দিয়ে প্রতিবেশী বা আত্মীয়ের কাছ থেকে সামান্য জমি বন্ধক নিয়ে চাষবাস করেন। এসব করে যতটুকু আয় রোজগার হয় তা দিয়েই ছয় সদস্যের পরিবারের ভরনপোষণ চালাতে হয়।
লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়ক ধরে জেলা শহর থেকে কিলোমিটার চারেক যাওয়ার পরেই মিলবে সাপ্টিবাড়ি-কালমাটি ইউনিয়ন সড়ক। সেই সড়কের আরও দুই কিলোমিটার এগিয়ে গেলে রাস্তার একপাশে দেখা মেলে বেশ কিছু নিচু জমি। স্থানীয়ভাবে যাকে বলা হয় দোলা। সেই দোলা থেকে তিন চারশ মিটার দূরেই তিস্তা নদী। জমিগুলোর কোনোটিতে তামাক, আলু কোনোটিতে সদ্য রোপণ করা হয়েছে বোরো ধানের চারা। চারপাশে কৃষকরা ব্যস্ত ফসলি জমির পরিচর্যায়।
সেই দোলার কর্দমাক্ত এক খণ্ড জমিতে দড়ি দিয়ে বাঁধা একটা মই ধরে টানছেন মাঝ বয়সী মফিজুল। মেদহীন শরীরে পেশীগুলো যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে। মফিজুলের মইটানাকে সহজ করতে কোদাল হাতে সহায়তা করছেন তার সহধর্মিণী তানজু বেগম। আত্মীয়ের কাছ থেকে ১৫০ টাকায় এক শতক জমি ভাড়া নিয়ে বোরো বীজ বুনেছিলেন। সেই চারা এনে বন্ধকি জমিতে রোপণ করতে চলছে জমি তৈরির কাজ।
মফিজুল বিটিসি নিউজকে জানান, দুই ভাই পাঁচ বোনের সবার ছোট সে। বাবা মোস্তাব আলী ছিলেন একজন প্রান্তিক কৃষক বা ক্ষুদ্র চাষি। বছর খানেক হলো তিনি মারা গেছেন। বাবার কাছ থেকে ভাগে পেয়েছেন সাত শতাংশ জমি। সেই সামান্য জমিতে ঘর তুলে বসবাস করেন। গত বছর জমানো ১ লাখ ১০ হাজার টাকা দিয়ে এক প্রতিবেশীর বিশ শতাংশ জমি বন্ধক নিয়েছেন। আবাদ করার খরচ নিজের না থাকায় কিছু ধার আর বাকিতে সার কীটনাশক নিয়ে সেই জমিতে লাগিয়েছিলেন আমন ধান। যে ধান পেয়েছিলেন তার কিছু বিক্রি করে মহাজনের (সার-কীটনাশক ব্যবসায়ী) বাকির টাকা শোধ করেছেন হালখাতায়। বাদবাকি রেখেছেন নিজের পরিবারের ছয় মাসের খাবার জন্য।
মফিজুল আরও জানান, তার চার সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে রহিমা পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে, মেজো মেয়ে জরিনা পঞ্চম শ্রেণিতে, সেজো মেয়ে মুন্নি মাদরাসায় আর ছোট মেয়ে মারিয়ার বয়স দুই বছর। মফিজুলের মা খাদিজা দুই ভাইয়ের সংসারেই ভাগাভাগি করে থাকেন। টানাপোড়েনের সংসারে ছয় সদস্যের খাবার জুটলে সন্তানদের পড়ালেখার খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হয়। সৌখিনতা বা বিলাসিতার ধারেকাছেও যেতে পারেন না মফিজুল।
গত বছর ধানের আবাদ ভালো হওয়ায় এবারও ধান আবাদে মনোযোগী হয়েছেন। এবার তার আশা গতবারের চেয়ে বেশি ফলন পাওয়ার। তিন বছর আগে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে বন্ধক নিয়েছিলেন ১০ শতাংশ জমি। এবার তার বন্ধক নেওয়া জমি হয়েছে ২০ শতাংশ। আরও বাড়াতে চান জমি, তারপর কিনতে চান নিজের নামে জমি। তাই শ্রমিক না নিয়ে নিজারাই কষ্ট করছেন জমিতে। সকাল-বিকেল খেয়ে না খেয়ে লেগে আছেন আবাদে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর লালমনিরহাট প্রতিনিধি হাসানুজ্জামান হাসান। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.